সৈয়দ মাসুদ মোস্তফাঃ বিগত ১৩ জুলাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন,‘আমি মুসলমানও নই, আবার হিন্দুও নই'। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় তার সরল স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ধর্মবিষয়ক তার অবস্থান জাতির কাছে পরিষ্কার করেছেন। তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে তিনি কোন ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী বা কোন ধর্মের অনুসারী বা প্রচলিত কোন ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীল নন বরং তিনি একজন ধর্মবিবর্জিত ব্যক্তি। মাননীয় মন্ত্রীর এ ধরনের সত্য কথনের জন্য তাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে কোন উপায় নেই।
প্রচলিত প্রত্যেক ধর্মের মূলমন্ত্রই হলো স্রষ্টার অস্তিত্বে অকৃত্রিম বিশ্বাস স্থাপন করা। ধর্মভেদে যদিও স্রষ্টার স্বরূপ আলাদা। কিন্তু বোধ-বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের কাছে স্রষ্টার অস্তিত্ব অভিন্ন। যে আদর্শ স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করে না তাকে নাস্তিক্যবাদী আদর্শ বলা হয়ে থাকে। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় তার অতিচমকপ্রদ মন্তব্যের মাধ্যমে নিজেকে নাস্তিক হিসেবে প্রমাণ করেছেন কিনা তা মূল্যায়নের দায়-দায়িত্ব জনগণের উপর ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়তর মনে করছি।
কিন্তু এখন অভিজ্ঞ মহলের প্রশ্ন মাননীয় মন্ত্রীর এ বক্তব্য কী তার একান্ত ব্যক্তিগত না এটা তাদের দলীয় ও রাজনৈতিক আদর্শ। বিষয়টি যদি ব্যক্তিগতই তাহলে এ নিয়ে কাগজ-কলম ও সময় নষ্ট করার কোন কারণ নেই। কিন্তু এটা যদি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন হয়ে থাকে তাহলে দেশের মানুষ একেবারে উদাসীন থাকতে পারে না বরং এতে জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী একটি ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্মই হয়েছিল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ' নাম দিয়ে। তাদের ভাষায় দলীয় নামের সাথে যেসব বিশেষণ থাকলে দলটিকে সাম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী বলা হয়, আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে সে বিশেষণ সম্পূর্ণ উপস্থিত। তাই দলকে কথিত সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ মুছে ফেলতেই বোধহয় পরবর্তীতে দলীয় নাম থেকে ‘মুসলিম' শব্দটিকে অতি যত্নসহকারে বিদায় করে দেয়া হয়েছিল। তাদের ভাষায় দলকে সার্বজনীন করার জন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তারপরও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে খোদ শেখ মুজিব পাকিস্তানের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমাদের গর্ধভীয় রাজনীতির কারণেই আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হয়েছে। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। ইতিহাসের সরলীকরণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছিল। দেশ শাসনও করেছিল প্রায় সাড়ে তিন বছর। এতে তারা কতখানি সফল বা বিফল হয়েছে সে সাক্ষ্য দেয়ার দায়ভার ইতিহাসের উপর ছেড়ে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
আওয়ামী লীগ ‘৭০-এর নির্বাচনে বা স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে কখনোই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেনি। তারা জনগণের কাছে বলেছিল শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক সমাজের কথা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সে কথার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেনি। ফলে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সমাজতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ৪ মূলনীতির মধ্যে গণতন্ত্র স্থান লাভ করলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করে তাদের ভাষায় অলঙ্ঘনীয় রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ‘গণতন্ত্র'র দাফন-কাফন সম্পন্ন করা হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীতে সংবিধানে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সংবিধানের শিরোনামায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন ও একদলীয় বাকশালী শাসনের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এসে সংবিধানে সর্বশক্তিমান আল্লাহ উপর আস্থা ও মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক তুলে দিয়ে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সংযোজন করেছে। একই সাথে তারা সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও বলবৎ রেখেছে। এসব বিষয় পরস্পর অসংগতিপূর্ণ কি-না তা অবশ্য আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। সময় পেলে আরেক দিনে এ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহারে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা না থাকলেও পরবর্তীতে তা সংবিধানে সংযোজন করে তারা ৪ দশক যাবত জনগণের কাছে প্রচার করে এসেছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতাই মানবতার মুক্তির একমাত্র গ্যারান্টি; তথা একটি মহৌষধ। এছাড়া অন্য কোন আদর্শ বা পন্থায় মানবতার মুক্তি বা কল্যাণ কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের জন্য কতখানি কল্যাণকর বা এর স্বরূপটাই বা কী তা-ই এখন আলোচনার বিষয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা, সংজ্ঞা এবং এর স্বরূপ নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান শুধু আমাদের দেশে নয় বরং পুরো বিশ্বেই প্রচলিত আছে। মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী-প্রবক্তারা যে ব্যাখ্যা দেন তার নির্যাসটা হলো ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কোনপ্রকার বাড়াবাড়ি করা যাবে না বরং ব্যক্তি তার নিজস্ব ধর্মাচারণও স্বাধীনভাবে পালন করবে। কোন ধর্মই কোন ব্যক্তির উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না বা কাউকে ধর্ম পালনে বাধ্যও করা যাবে না। ধর্ম ব্যক্তির নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কেউ ইচ্ছা করলে তার পছন্দ অনুযায়ী ধর্ম পালন করতে পারবে। আবার ইচ্ছা করলে সে কোন ধর্মই মানতে মোটেই বাধ্য নয়। আর ধর্মকে কখনো রাজনীতিতে বা সমাজজীবনের কোন ক্ষেত্রেই সম্পৃক্ত করা যাবে না। এই হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রবক্তা-অনুসারীদের মত।
কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধবাদীদের মতামত সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা বলতে চান যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মূলত ধর্মহীনতার নামান্তর। যে ব্যক্তি কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নয়, তিনিই শুধু ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে যেমন কোন ধর্মবিশ্বাসের স্থান নেই, ঠিক তেমনিভাবে এই মতবাদ ব্যক্তির কোন ধর্ম পালনের অধিকারও স্বীকার করে না। বিরুদ্ধবাদীরা অতি সংক্ষিপ্তভাবে বলতে চান, ধর্মে কোন নিরপেক্ষ স্থান নেই। হয় ব্যক্তিকে কোন ধর্মের অনুসারী হতে হবে, নয়তো ধর্মের বিরুদ্ধেই অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এখানে নিরপেক্ষ স্থান কোথায়? বিরুদ্ধবাদীরা যুক্তি-তর্ক ও তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু ধর্মহীনতাই নয় বরং এ মতবাদ অসহিষ্ণু ও চরমপন্থার ধর্মবিদ্বেষী মতবাদ।
এখন আমরা চেষ্টা করবো উভয়পক্ষের মতামতকে যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করার। ইংরেজি ‘সেক্যুলারিজম' শব্দ থেকেই বাংলা ভাষান্তর করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আর এ ভাষান্তর কতখানি যুক্তিযুক্ত তা নিয়েই সর্বাগ্রে আলোচনা হওয়া দরকার।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে মানুষের শারীরিক, নৈতিক ও বুদ্ধিভিত্তিক উৎকর্ষের অন্যতম চূড়া। এটি নাস্তিক্যবাদ, আস্তিক্যবাদ এবং বাইবেল থেকে ভিন্ন এক ধারণা যার মাধ্যমে প্রাকৃতিক ন্যায়পরায়ণতা জীবনের প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হবে। বস্তুভিত্তিক মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়া, ইতিবাচক চিন্তা-চেতনাকে ঐক্যের ভিত্তিতে বিবেচনা, যুক্তির মাধ্যমে জীবন পরিচালনা এবং সেবার মাধ্যমে জীবনকে মহিমান্বিত করা হলো ধর্মনিরপেক্ষতার নিয়মাবলি'।
ii. Secularism is a code of duty pertaining to this life founded on considerations purely human and intended mainly for those who find theology indefinite or inadequate,unreliable or unbelievable.Its essential priciples are three: The improvement on this life by materials means.That science is the available providence of man.That is good to do good.Whether there is other good or not,the good of present life is good and it is good to seek that good.(English Secularism,35)
‘ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল মানুষের ইহলৌকিক দায়িত্ব সংক্রান্ত নিয়মাবলি এবং যারা ধর্মতত্ত্বকে অপূর্ণ, অস্পষ্ট, আস্থা স্থাপনের অযোগ্য এবং অবিশ্বাস্য মনে করে এই আদর্শ তাদের জন্য। এর মূল উপাদান তিনটি: এক, ইহলৌকিক জীবনের উন্নয়ন কেবল বস্তুর মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব। দুই, বিজ্ঞানই মানুষের জন্য একটি প্রাপ্তিসাধ্য ঈশ্বর। তিন, যেকোন ভাল কাজই ভাল। অন্য কোন ভাল থাকুক বা না থাকুক বর্তমান জীবনের জন্য যা ভাল তার সন্ধানই শ্রেয়'।
‘ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ হচ্ছে এমন এক মতবাদ যা মনে করে আল্লাহ বিশ্বাস বা পরকাল বিশ্বাসনির্ভর সকল বিবেচনা থেকে মুক্ত মানব জাতির বর্তমান কল্যাণ চিন্তার ওপর ভিত্তি করে নৈতিকতা গড়ে উঠবে'।
No.2-The view that public education and other matters of civil society should be conducted without the introduction of a religious element.
সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতার একমাত্র অর্থ ধর্মহীনতা, কোন ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীল না থাকা বা খোদাদ্রোহিতা। ধর্মনিরপেক্ষতার এসব অর্থ ব্যতীত অন্য কোন অর্থ বা সংজ্ঞা পৃথিবীর কোন ডিকশনারিতে নেই। ধর্মীয় আচরণকে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের প্রত্যেক স্তর থেকে ধর্মকে মুক্ত রাখতে হবে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ধর্মকে পরিত্যাগ করাই এ মতবাদের লক্ষ্য। এ জন্য এ মতবাদকে ‘ধর্মহীন' বলায় অধিক যুক্তিযুক্ত।
উপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে ‘আমি মুসলমান বা হিন্দু কোনটাই নই' বলে যে মন্তব্য করেছেন তা তার ব্যক্তিগত নয় বরং তাদের রাজনৈতিক দর্শনেরই মর্মবাণী। আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা যে রীতিমত ধর্মহীনতা এতে কোনই সন্দেহের অবকাশ নেই। সে অর্থে কোন ধার্মিক লোকের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্য নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্যসেন বলেছেন অন্য কথা। তার মতে ধর্মনিরপেক্ষতার উৎপত্তি হিন্দুত্ববাদ থেকে এবং এটি হিন্দুত্ববাদের নবতর সংস্করণ। বাবু সেনের কথাও যদি মেনে নেয়া হয় তাহলে কোন অহিন্দুর পক্ষেও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। তাই সার্বিক দিকে বিবেচনায় একজন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ধর্মহীন তো বটেই, বড় জোর সে ব্যক্তি অমর্তসেনের ফর্মুলায় সংস্কারপন্থী হিন্দু হতে পারে। অন্য কোন ধর্মবিশ্বাসের দাবিদার হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু আমাদের দেশের কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা নিজেদেরকে অতি ধার্মিক হিসেবে জাহির করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ইসলামের সেবক ও রক্ষক সেজে বিড়ালতপসী হয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন। নির্বাচন এলেই ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকাবাহী শেখ হাসিনা মাথায় পট্টি বেঁধে, হাতে তসবি নিয়ে ওমরা পালন করে অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে জনগণের করুণা ভিক্ষা করেন। আর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পরই আবার তারা বেঁকে বসে দেশ ও জাতিকে ধর্মহীন করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আর সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যই সংবিধান সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা তুলে দিয়ে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সবসময় গণতন্ত্রের জন্য অশ্রুপাত করলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রকারান্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেই চরমভাবে পদদলিত করেছে। যে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থাশীল ও বিশ্বাসী সে দেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকারের ধুঁয়া তুলে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্থাপন করে আল্লাহর উপর আস্থা প্রত্যাহার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে কাদের উদ্দেশ্য পূরণ করা হয়েছে তা জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু আক্ষরিক অর্থে ধর্মহীনতা নয় বরং মারাত্মক ধর্মবিদ্বেষী খোদাদ্রোহী মতবাদ। এ আদর্শে বিশ্বাসীরা যেমন কোন ধর্মের অনুসারী হতে পারেন না, ঠিক তেমনিভাবে কোন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও নন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো যদি তাই হয় তাহলে আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মুখে ধর্মের জয়গান করতে শোনা যায় কেন? এর সোজা-সাপটা জবাব এই হতে পারে যে, আমাদের দেশের মানুষ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে ধর্মপ্রাণ। তাই ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এ দেশে রাজনীতি করা, জনসমর্থন লাভ ও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। তাই তারা ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতার অপব্যাখ্যা করে এ মতবাদকে ধর্মবান্ধব বলে আখ্যা দেয়ার অপপ্রয়াস চালানো হয় মাত্র। কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের অতীত আচরণ এ কথাই বার বার প্রমাণিত করেছে। দেশে নির্বাচনের সময় এলেই এসব বিড়ালতপসী তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা ধর্মের জন্য কুম্ভীরাশ্রুপাত করে থাকেন। তারা ক্ষমতায় গেলে ধর্মবিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। আর সে ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে খোদ শেখ মুজিব জাতির কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, তারা জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন প্রণয়ন করবে না। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন করে দেশ থেকে ধর্ম উৎখাতের জন্য ক্রুসেড ঘোষণা করে। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের মনোগ্রাম থেকে কুরআনের আয়াত ‘ইকরা বিসমি রাবিব কাললাজি খালাক' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে ‘রাবিব জিদনী ইলমা', সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ‘মুসলিম' কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ‘ইসলাম' শব্দ তুলে দিয়ে চরম ধর্মবিদ্বেষের পরিচয় দেয়। সে সময় দেশে ধর্মীয় রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আর এই ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে চরম ধর্মবিদ্বেষের কারণেই তাদেরকে দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের জনগণের সাথে প্রতারণা করার জন্যই তাদেরকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের বাইরে থাকতে হয়েছিল। তারা বোধহয় উপলব্ধি করতে পেরেছিল ধর্মবিদ্বেষের কারণেই দেশের মানুষ তাদেরকে আর পছন্দ করে না। তাই ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনা মাথায় কালো পট্টি বেঁধে, হাতে তসবী নিয়ে ওমরা পালন করে তাপসী রাবেয়া সেজে অতীত ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ভোট প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তারা তাদের বহিরাবরণ ধরে রাখতে পারেননি বরং তাদের ধর্মবিদ্বেষের স্বরূপ জনসমক্ষে ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে। সে সময় আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরের শাসনামলে ধর্মের উপর চরম আঘাত করেছিল। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ২৫০টি মাদরাসা। আলেম-উলামাদের উপর চালানো হয়েছিল অবর্ণনীয় নির্যাতন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা কুকুরের মাথায় টুপি ও গলায় তসবি পরিয়ে নিজের ধর্মদ্রোহিতার স্বরূপ প্রকাশ করেছিল। আর এজন্যই ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ধর্মদ্রোহী আওয়ামী অপশক্তির লজ্জাজনক পরাজয় ঘটেছিল।
২০০৬ সালে ৪ দলীয় জোটবিরোধী আওয়ামী নৈরাজ্যের সময় তারা আবারও ধর্মের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে এক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির উল্লেখযোগ্য ধারা ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশে কোন কুরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হবে না। এমনকি আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অনুরূপ ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা পাতানো ও ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তাদের আধিপত্যবাদী প্রভুদের খুশি করার জন্য দেশ থেকে ইসলাম উৎখাতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমে পড়েছে। আর তাদের সে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নকে নির্বিঘ্ন করার জন্যই তারা দেশের স্বনামধন্য ইসলামী ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে কথিত বিচারের নামে ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচার ও প্রহসনের আশ্রয় নিয়েছে। তারা তাদের ধর্মদ্রোহিতার অংশ হিসেবে সংবিধান থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা তুলে দিয়ে ‘বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বহাল রেখে আবারও জনগণকে ধোঁকা দিয়ে মারাত্মক ধর্মব্যবসায় অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহর উপর আস্থা তুলে দিয়ে সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কোন সার্থকতা আছে বলে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ মনে করছে না বরং সরকারের এ ধরনের গর্হিত সিদ্ধান্তকে দেশের মানুষ জনগণের সাথে চরম শঠতাই মনে করছে।
আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা যে ধর্মহীনতা এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এ আদর্শের প্রবক্তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যই সময়-সুযোগমত মানুষকে ধর্মের মহাত্ম্য শোনায়। কিন্তু কাজ ফুরালেই তারা আবার আসল চেহারায় আবির্ভূত হন। অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ ধর্মবিষয়ক যে মন্তব্য করেছেন, তা মোটেই তার ব্যক্তিগত মতামত নয় বরং তা তাদের আদর্শেরই সারবস্তু। মাননীয় মন্ত্রীর অসতর্কতার কারণেই তার মুখ থেকে এমন বেফাঁস মন্তব্য বের হয়েছে। তারা মনে প্রাণে সে আদর্শে বিশ্বাসী হলেও ধর্মপ্রাণ লোকদেরকে বিভ্রান্তির মাধ্যমে হাতে রাখার জন্য তা কখনোই জনসমক্ষে প্রকাশ করেন না। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী এমন মন্তব্য কেন করলেন? অবশ্য নিন্দুকরা (?) এর একটি চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা বলতে চান মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় অভ্যাসগত কারণে প্রায় সময়ই বা কোন কোন সময় বেসামাল থাকেন, তাই হয়ত নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের কুৎসিত চেহারাটা জনসমক্ষে প্রকাশ করে ফেলেছেন। আর যদি মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য যদি সুস্থচিন্তার বহিঃপ্রকাশ হয় তাহলে আমরা তাকে সবিনয়ে নিবেদন করবো তিনি যেন আগামী নির্বাচনে জনগণের কাছে ধর্ম সম্পর্কে তার অভিজ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটান, যদি তিনি সৎসাহসী হয়ে থাকেন!